নদীমাতৃক বাংলাদেশ এ কথাটি কিশোরগঞ্জের ক্ষেত্রে যথার্থ। কেননা হাওড় অধ্যুষিত এই জেলার নদ-নদীর মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, মেঘনা, ধনু, ঘোড়াউত্রা, বৌলাই, নরসুন্দা, মগরা, বারম্ননী, চিনাই, সিংগুয়া, সূতী, আড়িয়াল খাঁ, ফুলেশ্বরী, সোয়াইজানী, কালী, কুলা নদী ।
কিশোরগঞ্জ জেলার পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র, উত্তরে নেত্রকোনা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কংস, মগরা, বাউলাই এবং এদের অসংখ্য শাখা ও সংযুক্ত নদী ও খাল। এই নদীগুলো দক্ষিণদিকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরবের নিকট মিলেছে।
কিশোরগঞ্জের উল্লেখযোগ্য নদীসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ
ব্রহ্মপুত্রঃ কিশোরগঞ্জের সীমানা বরাবরে হোসেনপুর, পাকুন্দিয়ার টোক হয়ে কটিয়াদী, কুলিয়ারচর ও ভৈরবের প্রামত্ম ছঁয়ে ভৈরব বাজারের নিকট পতিত হয়েছে। এই অংশটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে সমধিক পরিচিত যা মৃত প্রায়। হোসেনপুর থানার সীমানা থেকে ভৈরব বাজার পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭ মাইল (প্রায় ৭৫ কি: মি:)।
মেঘনাঃ প্রায় ১০৪৬ কি: মি: (প্রায় ৬৫০ মাইল) দীর্ঘ মেঘনা নদী কিশোরগঞ্জের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এটি জেলার অষ্টগ্রাম ও কুলিয়ারচর থানার পাশ দিয়ে আরো সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে ভৈরব বাজারের নিকট পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিশেছে। কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাজার মেঘনার তীরের বিখ্যাত নদী বন্দর।
ধনু/ঘোড়াউত্রা/বাউলাইঃ ধনু মেঘনার উপনদী। অপর নাম বাউলাই। এটি সুনামগঞ্জ থেকে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী হয়ে কিশোগঞ্জের ইটনা থানায় প্রবেশ করেছে। মিঠামইন এবং নিকলীর নিকট এ নদী ঘোড়াউত্রা নামে পরিচিত। বাজিতপুরের উপর দিয়ে নদীটি কুলিয়ারচরের কাছে মেঘনায় পতিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জের সীমানায় এ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫ মাইল (প্রায় ৫৬ কি: মি:)। বাকময় গতির কারনে এর নামকরণ হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে।
নরসুন্দাঃ নরসুন্দা নদী হোসেনপুর - পাকুন্দিয়ার সীমানার নিকট ব্রহ্মপুত্রের সাথে সংযুক্ত। অন্যদিকে ইটনা উপজেলার বাদলার নিকট ধনু নদীর সাথে সংযুক্ত। স্থানীয়ভাবে এই সংযোগস্থল ‘‘চৌগাংগা’’ নামে পরিচিত। নরসুন্দাকে ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী হিসাবে ব্যাপকভাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিশোরগঞ্জে মূল নরসুন্দা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ মাইল (প্রায় ৫৮ কি: মি:)। এক সময় কিশোরগঞ্জ শহরের প্রধান আকর্ষণ ছিল এই নরসুন্দা এবং অদ্যাবদি তা কিশোরগঞ্জ শহরকে দুভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। একে নিয়ে অনেক গল্প, কাহিনী, কিংবদন্তী, রোমান্টিকতা কিশোরগঞ্জবাসীর মনে এখনো গেঁথে আছে। বর্তমানে মৃত নরসুন্দাকে ঘিরে কিশোরগঞ্জবাসী নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। বর্তমান সরকার নরসুন্দাকে খনন করে মনোরম লেক করার পরিকল্পনা করছে। এটি বাস্তবায়িত হলে কিশোরগঞ্জ একটি মনোরম শহর হিসাবে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষন করবে।
মগরাঃ মগরা নদীর প্রায় ৪০০ বর্গমাইল (৬৪৩ বর্গ কি: মি:) অববাহিকা রয়েছে। কিশোরগঞ্জের ইটনা থানায় প্রবেশের পূর্বে মগরা নদীর সাথে আরো নদীর স্রোতধারার মিলন ঘটেছে এবং সর্বশেষে নেত্রকোনা জেলার মদন থানার প্রামত্ম ছুঁয়ে ইটনার গন্দবপুর গ্রামের নিকট ধনুতে পড়েছে। মগরা নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৯ মাইল (প্রায় ১২৭ কি: মি:)।
বারম্ননীঃ নেত্রকোনা জেলার সীমানা পেরিয়ে বারম্ননী নদী ইটনা ও তাড়াইল থানার সীমানা বরাবর কিশোরগঞ্জে প্রবেশ করেছে এবং নরসুন্দায় পতিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জ অংশে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ মাইল (প্রায় ৯.৬ কি: মি:)।
চিনাইঃ নেত্রকোনা জেলা অতিক্রম করে চিনাই নদী ইটনায় প্রবেশ করেছে। মগরা নদীর সাথে মিলিত হয়ে ধনুতে পতিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জ অংশে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ মাইল (প্রায় ৪.৮ কি: মি:)।
সিংগুয়াঃ সিংগুয়া নদী পাকুন্দিয়ার এগারসিন্দুরের খামাবিল হতে উৎপন্ন হয়ে গচিহাটা ও নিকলী হয়ে ঘোড়াউতরায় মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪ মাইল (প্রায় ২২.৪ কি: মি:)।
সূতীঃ গচিহাটা রেল স্টেশনের ৫ মাইল উত্তর পূর্বে-সিংগুয়া নদী হতে উৎপন্ন হয়ে নকলা ফেরীঘাট অতিক্রম করে সূতী নদী চানপুর হাওরের পূর্ব পাশ দিয়ে রউহা বিল হয়ে ঘোড়াউত্রায় পতিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ মাইল (১১.২ কি: মি:)।
আড়িয়াল খাঁ:ব্রহ্মপুত্রের সাথে সংযুক্ত আড়িয়াল খাঁ কটিয়াদী থানার একটি মৃত নদী। কটিয়াদীর কুটির বিল এ নদীর উৎস। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৭ মাইল (প্রায় ১১.২ কি: মি:)।
ফুলেশ্বরীঃ কবি চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের করম্নণ স্মৃতিধন্য ফুলেশ্বরী নদী। ফুলেশ্বরী তাড়াইলের জালিয়া হাওড় হতে বের হয়ে তেউরিয়া ও কাওখালীর পূর্ব দিক দিয়ে ধলা গ্রামের পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে, জাওয়ার ও সেকান্দর নগরের ভিতর দিয়ে পাতুয়াইর গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিতহয়ে পশ্চিমে নরসুন্দার সাথে মিলিত হত। এ নদী আজ মৃত।
ধলেশ্বরীঃ এ নদী মেঘনা নদীর একটি শাখা নদী। অষ্টগ্রামে মেঘনা নদী থেকে এ নদীর উৎপত্তি। অষ্টগ্রামে এ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ মাইল।
সোয়াইজানীঃ এটি ঘোড়াউত্রার শাখা নদী, নিকলী থানার অন্তর্রভূক্ত। নিকলীতে ঘোড়াউত্রা ও নরসুন্দার সাথে এই সোয়াইজানীর মিলন ঘটেছে।
কালী নদীঃ ঘোড়াউত্রা নদী যেখানে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে সেখান থেকে কালী নদী ভৈরব ও বাজিতপুরের সীমানার মধ্য দিয়ে কুলিয়ারচরে প্রবেশ করেছে। ভৈরবের গজারিয়া ইউনিয়নের মানিকদী পার হয়ে আরো দক্ষিণে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে শেষ হয়েছে।
কূলা নদীঃ বাজিতপুরের মাইজচর ইউনিয়নের মাইজচর গ্রামের পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে ঘোড়াউত্রা নদী সরাসরি দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। এ অংশটি স্থানীয়ভাবে কূলা নদী নামে পরিচিত। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৫ কি: মি:।
এছাড়াও আরো অসংখ্য ছোট ছোট নদ/নদী জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকা জুড়ে।
গ্রন্থনাঃ সারোয়ার আহম্মদ খান
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS